ভালোবাসার কোনো রকম হয়না। আবার ভালোবাসা হাজার রকম হয়, হাজার রকম ভালোবাসা হয় বড়দের ভালোবাসার মধ্যে; যাদের ভালোবাসা মূলত হয় স্বার্থোদ্ধারের কারণ হিসেবে। কিন্তু যাদের মধ্যে 'স্বার্থ' শব্দটারই কোনো অর্থ নেই, তাদের ভালোবাসাই মূলত এখন ভালোবাসার নিরেট আর প্রকৃত রূপ। তবে বর্তমান সমাজে- শুধু মাতৃস্নেহ ছাড়া - এই নিস্বার্থ ভালোবাসার উদাহরণ খুবই বিরল।
আজ আমি এক ভিন্ন রকম ভালোবাসার গল্প শোনাবো।
গতকাল, একটু আগে বাসায় পৌছেছিলাম বলে ববা'কে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম কাছেই- গান শুনতে। তখন চলছিলো প্রিয়শিল্পী ফেরদৌস আরা'র গান। আমি গান শুনছিলাম মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায়। অল্প ক'জন দর্শক ছিলেন; বোধকরি সবাই গানপ্রিয়। সবাই গানপ্রিয় বলছি এই কারণে- কারণ যতক্ষণ শিল্পী গান গাইছিলেন; পুরো প্যান্ডেলে ছিলো পিন পতনের নিরবতা।
প্যান্ডেলে দর্শকদের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারগুলো সুদৃশ্য কাগজে ইংরেজি অক্ষরের ছাপ লাগিয়ে "জেন্টস"-"লেডিস"-"গেস্ট" চিন্হিত করা রয়েছে।
হয়তো প্রচার কম ছিলো কিংবা ছিলো না; তাই আশানুরূপ দর্শক হয় নি। আমরা ফাঁকা প্যান্ডেলে, চেয়ারগুলোর মধ্য থেকে প্রথমদিকে; একেবারে স্টেজের কাছাকাছি গিয়ে বসার সুযোগ নিয়ে গান শোনার সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাই নি। ববাও আমার পাশে বসে চুপটি করে উপভোগ করছিলো।
মধ্যিখানে অনুষ্ঠান বিরতিতে ববা'র আব্দার;- বাবা একটা কথা বলবো?
- হা বলো- বাবা!
- তুমি রাগ করবা না তো!
- কী? কী বলবা - বলো না! চিপস? না- কোকোমোমো?
- না- ওসব না। আগে বলোনা তুমি রাগ করবা না!
সম্প্রতি এই বিষয়টা বেশ লক্ষ্য করি; ববা বড়দের মন বুঝে কথা বলে। আমার কিংবা তার মা'র যখন কোন কারণে মন খারাপ থাকে- তখন সে পারতপক্ষে কোন দাবি তোলে না। যখন বুঝে যে বাবা-মা'র মন খুব বেশি খারাপ; তা এতটাই খারাপ- যে খুব শীঘ্র স্বাভাবিক হয়তো হবে না; কিন্তু ততক্ষণে তার প্রয়োজনটি পূরণ না হলে ওটার আর প্রয়োজন থাকবে না; তখনই কেবল - এভাবে অনুমতি নিয়ে আমাদের সামনে তার প্রয়োজনটি পেশ করে।
ওর এই অনুমতি নেবার বিষয়টা, অনুমতি নেবার ধরনটা আমায় আহত করে, আমি পীড়িত হই, আমি দহিত হই। কারণ ওর যা বয়স, ওই বয়সে - আমি যদিও বাবার সামনে কোনো দাবি রাখতাম না, সব দাবি মায়ের কাছেই দাখিল করতাম; মা যথাসাধ্য মিটাতে সচেষ্ট থাকতো, তবু - আমার পুত্র যেন আমার কাছে কিছু চাইতে কোনো সংকোচ না করে -আমি সেটা চাই। চাই খুবই আন্তরিকভাবে- কারণ পিতা হিসেবে যে সময়টুকু, যে স্নেহটুকু, যে কর্তব্যটুকু সন্তানদের প্রাপ্য বলে আমি মনে করি; আমার শত আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও - আমি তা ওদেরকে দিতে পারি না। এজন্য আমি ওদের সামনে গেলে, বিশেষকরে এভাবে - যেভাবে অফিসে বস-অধস্তনদের অনুমতি নিয়ে- কেমন একটা দূরত্ব দূরত্ব্ভাব নিয়ে কাজ করতে হয়, সেইটা আমার আর আমার সন্তানদের মধ্যে আসুক- আমি চাইনা। আমি চাই পিতা-পুত্রের সম্পর্কটা হোক একটা "নিবিড় বন্ধুত্ব"। সেই কারণেই ওর এই কাতর আর শিশুকোমল বিনয়ে অনুমতি নেওয়া আমাকে অলক্ষ্যে নিরন্তর আঘাত করে।
আমি এই মানসিক আঘাত বুকে নিয়ে- প্রতিবার; যতবার এভাবে অনুমতি নিয়ে কিছু বলে- সাধ্যি থাক-না থাক; বলে থাকি;
- না বাবা, আমি রাগ করবো না। তুমি বলো।
- বাবা, এখন তো গান থেমে গেছে; চলোনা- একটু দেখে আসি - দোলনাটা ঠিক জায়গায় আনলো কিনা!
- না বাবা, আমি রাগ করবো না। তুমি বলো।
- বাবা, এখন তো গান থেমে গেছে; চলোনা- একটু দেখে আসি - দোলনাটা ঠিক জায়গায় আনলো কিনা!
কদিন ধরেই- একুশে ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠান, আজকের অনুষ্ঠান, এই সব কারণের কর্তৃপক্ষ দোলনাটা যেখানে থাকে- সেখান থেকে একটু সরিয়ে রেখেছে; যাতে বাচ্চাদের ছুটোছুটিতে অনুষ্ঠানের আয়োজনে কোনরূপ বিঘ্ন না ঘটে, তাই।
আমি অফডে পেলে ওর ভাষায় এই 'দোলনা', আসলে ওটা দোলনা নয়; মই বেয়ে ছ'পা উঠে বসে পড়া - আর মুহুর্তে পিছল কেটে নিচে নামা- আমিও ঠিক নাম জানি না; আমার ছেলে ওটাকেই দোলনা বলে; যাকগে, নাম যাই হোক- ববা'র কাছে ওটা যখন দোলনা-আমার কাছেও ওটা দোলনা-ই সই; যেটা চড়তে খুব পছন্দ করে- ওর এই ইচ্ছেটাকে পূরণ করতে চেষ্টা করি।
গানের মুর্ছনায় আবিষ্ট থাকলেও বুঝলাম ববা'র প্রিয় খেলনা; দোলনা চড়ার ইচ্ছে হচ্ছে। তাই রাত যতই হোক; আমি এই ইচ্ছেটুকু পূরণ করতে কার্পন্য না করে; ওকে নিয়ে দ্রুত দোলনার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম আর বললাম;
- তোমার বুঝি এখন দোলনা চড়তে ইচ্ছে হলো! ঠিক আছে, চলো বাবা দেখে আসি।
- না, বাবা শুধু দেখবো জায়গামতো ওটা এনেছে কী না? এখন উঠবো না, যদি ওটা ঠিক জায়গায় নিয়ে আসে- কাল ছুটির পর মা আর ভাইকে নিয়ে আসবো !
- ওহ! তাই বুঝি!- হা।
- ওকে। চলো।
দোলনাটা যেখানে বসানো থাকে- সেটি গানের অনুষ্ঠানটি থেকে মিনিট দু'য়ের দূরত্বে হবে। একটা সরু পথ; দু'ধারে উচু দেয়াল; পথে আলোও অপর্যাপ্ত। আমরা হাত ধরাধরি করে হাঁটছি। হঠাত ববা হাত চেপে ধরে বলে উঠলো- থাক বাবা, আজ আর যেতে হবে না; চলো আমরা শেষ গানটা - কির্তন শুনি।
বুঝলাম এই রাস্তাটুকু ববা'র ভালো লাগেনি; সে জন-মানবহীন এই পথটুকু যেতে ভয় পাচ্ছে; জিজ্ঞেস করলাম - কেন বাবা? তুমি তো দোলনা চড়তে কাল ভাইকে নিয়ে আসবে বললে- তো!
- না বাবা, কেমন যেন অন্ধকার! ভয় ভয় করে না! তোমার কী ভয় করে না?
- না বাবা, কীসের ভয়? আমি আছি না! কত লোক তো ওখানে গান শুনছে! ভয় কিসের? তুমি চলো তো! বলে আমি ছেলেকে একটু সাহস যোগাতে চেষ্টা করলাম; আর তার অমতে, এক প্রকার জোড় করেই দোলনার কাছে নিয়ে যাই। আলো-আধারির অস্পষ্ট দৃষ্টিতে আমি দেখার আগেই ববা'র নজর পড়েছে - সেটি দূরেই পড়ে আছে;
- না, চলো বাবা, দোলনাটা আনে নি।- কাল তাহলে কী ভাইকে নিয়ে আর একবার এসে দেখবে?
- না। কাল আসবোনা। তোমার সাথে একবারে ফ্রাইডে আসবো। এর মধ্যে অবশ্যই এনে ফেলবে।
ববা'র মন খারাপ, বুঝতে অসুবিধা হয়নি। আমি কষ্টটা লাঘব করার জন্য নিস্ফল চেষ্টা করি, বলি;
- বাবা, চলো চিপস খাই; তোমার একটা আর ভাইয়ের একটা। আমিও একটু খাবো।
- না, বাবা। তুমি তো কাল স্বপ্ন থেকে অনেকগুলো চিপস এনেছো, এখন আর লাগবে না। চলো আমরা কির্তন শুনি।
- বাবা, চলো চিপস খাই; তোমার একটা আর ভাইয়ের একটা। আমিও একটু খাবো।
- না, বাবা। তুমি তো কাল স্বপ্ন থেকে অনেকগুলো চিপস এনেছো, এখন আর লাগবে না। চলো আমরা কির্তন শুনি।
অনুষ্ঠান শেষে দ্রুত পায়ে বাসায় ফিরি। ববা'র ঘরে ঢোকামাত্র মাকে জিজ্ঞাসা- মা, ভাই কই? আমি ভাইয়ের জন্য একটা জিনিস এনেছি। মজার জিনিস। ভাই খুশি হবে। অনেক খুশি হবে!
কী জিনিস কিংবা ভাই কতটা খুশি হবে- না ভেবে আমি ববা'র চোখে রাজ্যের খুশি খুঁজে পেলাম আর ওর মায়ের পাশেই এখনও কথা না ফোঁটা ভাইকে দেখেই প্যান্টের পকেট থেকে আমার অলক্ষ্যে সযতনে ভাঁজ করে রাখা এক টুকরা সাদা 'A4' সাইজের কাগজ বেড় করে ভাঁজ খুলে হাতে দিলো; আমি আর ওর মা উদগ্রীব আগ্রহ নিয়ে চেয়ে দেখি কাগজখানিতে কিছু নেই; শুধু ইংরেজি বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে "জিইএনটিএস"।
উপহারটা হয়তো অনেকের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ; তবে আমার কাছে ওটা ছিলো অনেক "বড় উপহার", যেটা শুধুমাত্র অপার্থিব স্নেহ আর নিস্পাপ ভালোবাসার এক সুনিপুন মিসেল ছাড়া অনুভব করা অসম্ভব; যার মধ্যে কোনো অর্থমূল্য নেই- তবে অমূল্য আবেদন লুকিয়ে আছে, আমি ভাইয়ের প্রতি দাদার এই ক্ষুদ্র উপহারে সেটাই খুঁজে পেয়েছি। তাই তো মনের অজান্তেই এক অব্যক্ত আনন্দের ছোঁয়ায় অনুভব করেছি চোখের কোনায় জল চলে এসেছে। আমি নিজেকে লুকোতে চেষ্টা করে শুধু বলেছি 'বাবা ভাইয়ের প্রতি এই ভালোবাসাটুকু সযতনে বাঁচিয়ে রাখিস, কোনো দুরত্ব যেন কোনোদিন তোদের মাঝে এসে দেয়াল গড়তে না পারে- আমরা তাহলেই খুশি হবো, খুব বেশি খুশি হব রে বাবা!'
বেশ লাগল এই পিতা পুত্রের নিবিড় বন্ধন
উত্তরমুছুনআর ভাইয়ের জন্য উপহার শুধু উপহার নয় এযে অন্তরের ভালবাসা
হা হা -একদম মনের কথা ধরেছেন।
মুছুনআসলে কী ক্ষুদ্র জীবনে "ভালোবাসা" ব্যতীত আর কোনো কিছু থেকেই অন্তরের প্রশান্তি সম্ভব না। আর পিতা-পুত্র, মাতা-কন্যা অর্থাৎ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসার গুরুত্ব অপরিমেয়; এই সম্পর্কে ভালোবাসার ঘাটতি হলে জীবন ধারণ অর্থহীন-অসম্ভব।
আমার মন বলে ভালোবাসা ছাড়া জীবন ব্যর্থ আবার ভালোবাসা মূল্য দিয়ে পাওয়া যায় না; ভালোবাসা পেতে ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই খরচ করতে হয় না,
তাই যথাসাধ্য মেইনটেন করতে চেষ্টা করি।
সময় ব্যয় করে এই অর্বাচীনের প্যাঁচাল পড়ার জন্য নিরন্তর কৃতজ্ঞতা।
আপনার প্রতি আন্তরিক শুভকামনা।